ভূমিকা:
মার্ক্সবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বহু কমরেড-ই বলে থাকেন ট্রান্স আইডিওলজি এবং সমকামিতা ভাববাদী ধারণা। অর্থাৎ, বস্তুবাদী এবং মার্ক্সীয় দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ দ্বারা ইহা ব্যাখ্যা অসম্ভব। তারা রেনে দেকার্টের উক্তি “I think, therefore I am” উল্লেখ করেন। বস্তুবাদীরা রেনের ভাববাদী উক্তির বিপক্ষে বলেন, “I am, therefore I think” এই উক্তির মাধ্যমে বস্তুবাদীরা বোঝাতে চান বস্তু, ভাবনার পূর্বে এবং স্বতন্ত্র ভাবে অস্তিত্ব রাখে। এখন যাদের উপরোক্ত বিষয় নিয়ে বিশদে জানা নেই, তার মনে হবে সমকামিতা এবং ট্রান্স আইডিওলজি হলো “ভাববাদী”, সুতরাং মার্ক্সবাদ যেহেতু “বস্তুবাদী” তাই ট্রান্স-ফোবিয়া’কে যুক্তিসম্মত করার অন্যতম পথ হলো মার্ক্সবাদ! পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখবো এই ধারণা ঠিক কতখানি ভুল এবং বামপন্থী মুক্তি আন্দোলনের পরিপন্থী। প্রথমত, আলোচ্য বিষয়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ শব্দের অর্থ নিয়ে ভুল ধারণা দূর করে নেওয়া প্রয়োজন। আলোচনায় ব্যবহৃত “বস্তুবাদ” শব্দের অর্থ পার্থিব সম্পদ ও বস্তুর প্রতি আকর্ষণ বোঝাচ্ছে না। “ভাববাদ” বলতে আলোচ্য অংশে ভালোবাসা বা বিশ্বাস জাতীয় আদর্শবাদী চিন্তাধারার কথা বোঝানো হচ্ছে না। সমস্ত শব্দের দর্শনগত অর্থ নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। মার্ক্সবাদ-এর মূল বিষয় হলো দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ। আসুন জেনে নিই সেটা কী?
দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ:
বস্তু এবং ভাবের দ্বন্দই হলো দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ। এবং অপর বিষয় হলো “দ্বান্দিকতা” (ডায়ালেক্টিক্স)। যেকোনও বিতর্কে একটি তত্ত্ব (থিসিস) উত্থাপিত হয় এবং তার বিরোধে বিরোধাভাস (এন্টিথিসিস)-এর উৎপত্তি হয়। এই দুই তত্ত্বের দ্বন্দে সংশ্লেষ বা সিন্থেসিস লাভ করা যায়। প্লেটো থেকে হেগেল সকল দার্শনিক এই দ্বান্দিকতার কথা বলে গেছেন। কিন্তু এই দ্বান্দিকতা ভাববাদী!
কিন্তু অত্যাচারী ছাড়া অত্যাচারিতের উপস্থিতি সম্ভব নয়। ঠিক একইভাবে প্রলেটেরিয়াৎ বা শ্রমজীবি ছাড়া বুর্জোয়া বা মালিকের উপস্থিতি অসম্ভব। তাই, থিসিস এবং এন্টিথিসিসি-কে ভিন্ন এবং পৃথকভাবে উৎপত্তি হওয়া সত্ত্বা ভাবা ভুল! উভয়েই একইসঙ্গে উত্থাপিত হয় এবং পরস্পরের সাথে ঐক্য (ইউনিটি) এবং দ্বন্দে বিদ্যমান।
দেখুন কিভাবে মার্ক্স ডায়ালেকটিক্সকে শুধুমাত্র বিতর্কের বেড়াজালে আবদ্ধ না রেখে তাকে বের করে এনে সমাজের শ্রেণীগুলির পারস্পরিক দ্বন্দে প্রতিফলিত করল। এই দ্বন্দই ইতিহাসের অগ্রগতির দিকনির্দেশ করে। ইহাই ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। এই ভাববাদ ও বস্তুবাদের দ্বন্দই “দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ”।
ট্রান্স আইডিওলজি না মার্ক্সবাদ?
ট্রান্সজেন্ডার বলতে, কোনও ব্যক্তির মানসিক লিঙ্গ চেতনা তার জন্মোক্ত লিঙ্গের ভিন্ন বোঝানো হয়। সহজ ভাষায়, ভিন্ন লিঙ্গের শরীরে কারোর জন্ম হলে তাকে ট্রান্স বলা হয়। এখন, ভূমিকায় উক্ত ধারণা থেকে বহু মানুষই মনে করেন ট্রান্স একটি ভাববাদী ধারণা এবং মার্ক্সবাদ বস্তুবাদী। এই কারণে মার্ক্সবাদ দিয়ে ট্রান্স আইডিওলজি ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। কিন্তু, কার্ল মার্ক্স এর মতবাদ অনুযায়ী তত্ত্বগত ভাবে মার্ক্সবাদ সমাজকে তার সম্পূর্ণতায় ব্যাখ্যা করতে পারে। কোনও এক ক্ষেত্রে কার্যকরী না হলেই মার্ক্সবাদ তার যৌক্তিকতা হারায়। কিন্তু এই চিন্তাধারার মুল ভ্রান্তি হল মার্ক্সবাদ দ্বন্দমূলক বস্তুবাদী, বস্তুবাদী নয়। দ্বান্দিকতা ব্যাতিত মার্ক্সবাদের কোনও অস্তিত্ব নেই। ফ্রেডরিক এঙ্গেলস বারবার মার্ক্সীয় দ্বন্দমূলক বস্তুবাদের সাথে যান্ত্রিক বস্তুবাদের পার্থক্য দেখিয়েছেন তার লেখনীর মাধ্যমে। আবার, ট্রান্স ও সমকামী মুক্তি আন্দোলন এবং পিতৃতন্ত্রের দ্বৈত নিপীড়ন এর ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে এক ভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।
ট্রান্স ও সমকামী নিপীড়নের উৎস: পিতৃতন্ত্র!
মার্ক্সীয় চিন্তাবিদদের গবেষণায় সমকামিতা এবং ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে আলোচনা তুলনামূলক কম হয়েছে। সেই কারণে এই বিষয়গুলি নিয়ে মধ্য ও দক্ষিনপন্থীদের পুঁজিবাদ তোষণকারী ভাবধারা স্থান পেয়েছে। যা এই বিষয়গুলি সম্পর্কে সম্পূর্ণ আলোকপাত করতে পারে না। মার্ক্সবাদীরাও এই বিষয়গুলি আলোচনায় গুরুত্ব দেননা কারণ মার্ক্সীয় তত্ত্বের জনকরা এই বিষয়ে বিশদে আলোচনা করেননি। কিন্তু, মার্ক্সবাদী হিসেবে নিপীড়িতদের সমস্যা তুলে ধরা কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তাই সমকামিতা ও ট্রান্স অধিকার আন্দোলন এবং মার্ক্সবাদ-এর আলোচনা আবশ্যিক। এই কারণে সুইস্ রেড স্টার পত্রিকার কমরেডরা এই বিষয়ে গবেষণা করছেন। তাঁদের প্রকাশিত গবেষণা পত্রই এই প্রবন্ধের মূল উৎস।
এই নিপীড়নের মূল কারণ হলো পিতৃতন্ত্র! তাই মার্ক্সীয় তাত্বিকদের (যেমন- এঙ্গেলস) “পিতৃতন্ত্রের নারী নিপীড়ন” এর আলোচনা থেকে এই বিষয়ে বিশদে আলোচনায় সাহায্য মেলে।
এই বিষয়ে আলোচনার সময় LGBTQIA+ কমিউনিটি-কে ট্রান্স ও সমকামী বলে উল্লেখ করা হবে আলোচনার সুবিধার্থে। এঙ্গেলস তাঁর বই “The origin of family, private property and the State”- এ দেখিয়েছেন যে মানব সমাজের বিবর্তনের ইতিহাসকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় - ১. বর্বরতা, ২. অসভ্যতা, ৩. আধুনিক সমাজ। এই তিনভাগের মধ্যে গুহামানব ও প্রস্তর মানব, যারা দল বেঁধে শিকার করে বাঁচতো তাদের প্রথম ভাগে বোঝানো হয়েছে। সমাজ গঠনের দ্বিতীয় ভাগকে “অসভ্যতা” বিভাগে বোঝানো হয়েছে এবং রাজতন্ত্র থেকে সামন্ততন্ত্র এবং আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজকে তৃতীয় বিভাগে বোঝানো হয়েছে। সমাজের এই তিন কাল বিভাগের মাধ্যমে আমরা প্রিমিটিভ কমিউনিস্ট সমাজ ও তার নিঃশেষ হয়ে কিভাবে পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হলো জানবো। আর জানবো পিতৃতন্ত্রের দ্বৈত নিপীড়ন নারী এবং ট্রান্স ও সমকামী মানুষের ওপরে।
পিতৃতন্ত্রের উৎপত্তি:
মার্ক্সবাদ অনুযায়ী সমাজের তিনটি কালভাগের থেকে পিতৃতন্ত্রের সূচনা সম্পর্কে জানা যায়।
প্রথম কালভাগ, অর্থাৎ “বর্বরতা” হলো সমাজ গঠনের সর্বপ্রাচীন ধাপ। এই সময় বিবাহ প্রথার পরিবর্তে গ্রুপ বিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। অর্থাৎ বিবাহ দুটি ভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে হতো, কোনও ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজ ছিল না। এই সমাজকে “প্রিমিটিভ কমিউনিজম” বলা হয়। এই সমাজে শ্রমের ক্ষেত্রে কোনও লিঙ্গ বিভাজন ছিল না। জেন্ডার রোলস ছিল অনুপস্থিত। শিশুদের লালন-পালন থেকে শিকার তথা খাদ্য সংগ্রহ সমস্তটাই হতো সমাজবদ্ধ ভাবে। এমনকি যৌন সম্পর্ক শুধু মহিলা-পুরুষ এই দ্বৈত ব্যবস্থায় সীমাবদ্ধ ছিল না। যে কোনও লিঙ্গের মানুষ যেকোনও লিঙ্গের মানুষের সাথে শারীরিক সম্পর্কে থাকতে পারত। বর্তমান লিঙ্গচর্চায় যে যৌন সম্পর্ককে “বাই-সেক্সুয়াল” বলা হয়, তার প্রচলন বহুল ভাবে উপস্থিত ছিল। বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতার কবরে কোনও মানুষের মৃতদেহ রাখা হলে, তার সাথে তার প্রিয়জনকে কবর দেওয়া হতো। এমনি অনেক কবরে নারী পুরুষ উভয় লিঙ্গের সঙ্গীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।
এবার আসি এর পরবর্তী তথা দ্বিতীয় কাল ভাগ “অসভ্যতা” (savagery) তে। এই সময় থেকে মানুষের খাদ্য সুরক্ষা বাড়ে পশুপালক থেকে কৃষিকাজ করা সমাজে রূপান্তরিত হবার কারণে। স্বাভাবিকভাবেই দলবদ্ধভাবে বাস করার আর কোনও প্রয়োজন ছিল না। মানুষ তখন ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজের দিকে এগোতে থাকলো। মানব বিবর্তনের এই ধাপটি নজরে রাখা প্রয়োজন, কারণ এই সময় থেকেই পিতৃতন্ত্রে সূত্রপাত ঘটে। এঙ্গেলস তাঁর বইয়ে লিখলেন, “In this stage, one man lives with one woman, but the relationship is such that the polygamy and occasional infedelity remain the right to the men, even though for the economic reasons polygamy is rare. While for the women, strictest fidelity is demanded throughout the times she lives with the man. And adultery on her part is cruelly punished. The marriage however can be dissolved by both partners, although rights of children belong to the women like before (in barbarism).”
শেষ অংশ থেকে বোঝা যায় পূর্বতন ব্যবস্থায় একাধিক লোকের সম্পর্ক থাকায় বাচ্চাদের বায়োলজিক্যাল পিতৃত্ব প্রমান অসম্ভব ছিল, তাই সকল নবজাতক এবং সর্বোপরি সমাজ ছিল মাতৃকেন্দ্রিক, কারণ মা ই সন্তানের জন্ম দিতেন। তাই প্রিমিটিভ কমিউনিস্ট সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। কিন্তু দ্বিতীয় কলভাগে শ্রমব্যবস্থার উৎপত্তি হওয়ায় সমাজ ব্যবস্থা মাতৃতান্ত্রিক থেকে পিতৃতন্ত্রের দিকে এগুলো। কারণ দলবদ্ধতা ভেঙে ব্যক্তিসত্ত্বার প্রচলন বাড়ে, তাই পুরুষ কেন্দ্রিকতাও বাড়ে সাথে সাথে। শ্রম ব্যবস্থায় পুরুষ শ্রমের সমস্ত জায়গা অধিকার করে, ফলে শ্রম থেকে উৎপন্ন সম্পত্তি ও “surplus value” পুরুষের মালিকানাধীন হয়। শ্রম ব্যবস্থায় নারীর স্থান না থাকলেও সন্তানের অধিকার এখনও নারীর ই রইলো। তবে কোনও সম্পত্তি না থাকায় পরবর্তী প্রজন্ম কে দেওয়ার জন্য “ইনহেরিটেড উইল” থাকলো না। এই ইনহেরিটেন্স যদি সন্তানের কাছে প্রতি প্রজন্মে সঞ্চিত করা যায়, তবেই “প্রাইভেট প্রপার্টি” পাওয়া সম্ভব। তাই, তৃতীয় কলভাগ তথা “আধুনিক সভ্যতা” (সামন্ততান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা)-য় মাতৃতন্ত্রের জায়গায় স্থান পেলো পিতৃতন্ত্র। নারী হারালো সমাজের সমস্ত অধিকার, জন্ম হলো দ্বৈত নিপীড়নের মূল কান্ডারী পিতৃতন্ত্রের!
এঙ্গেলস বললেন, “The overthrow of mother right was the historical defeat of the female sex. man took the command in the home also; the woman was degraded to servitude. She became the slave of his lust and reduced to a mere instrument of producing children!”
জন্ম হলো শ্রেণী বিভাজনের এবং শ্রেণী সমাজব্যবস্থার! সম্পত্তি রক্ষার লালসা বজায় থাকলো বর্তমান পুঁজিবাদী সভ্যতা পর্যন্ত। বজায় থাকলো পিতৃতন্ত্র!
Historical Queer Opression:
অনেকেই বলবে ঐতিহাসিক ভাবে মহিলাদের নিপীড়ন থাকলেও সরাসরি ভাবে কোথাও মার্ক্সিস্ট দার্শনিকরা সমকামী নিপীড়নের কথা উল্লেখ করেননি। এটাই আক্ষরিক অর্থ গ্রহণের সমস্যা। পরবর্তী প্রজন্মের মার্ক্সবাদীদের-ই এই সমস্যা গুলির উপর মার্ক্সবাদ কার্যকরী করে সমাধান অনুসন্ধান করতে হবে। মার্ক্সবাদ হল একটি বিবর্তনশীল বিজ্ঞান, বিবর্তন না হলে বা পরবর্তী প্রজন্ম নতুন সংযোজন না করলে “dogmatic revisionism” ছাড়া কিছুই থাকবে না।
আসুন এবার তিনটি কালভাগ-কে সমকামী নিপীড়নের প্রেক্ষাপটে দেখে নিই। সুইজারল্যান্ড এর মার্ক্সবাদী গবেষকদের পত্রিকা সুইস রেড স্টার অনুযায়ী, “There is no evidence of queer antagonism in savage society, but plenty of evidence that suggests bisexuality as main form of human attraction. All primates observed in nature found to have bisexual tendencies, with bonobo apes being fully bisexual. Neanderthals were commonly buried with partners of both sexes, the leading hypothesis being that they were all bisexual.”
শ্রেণীবিভাজিত সমাজের অস্তিত্বের পূর্বে সমকামী বিরোধিতার কোনও প্রমান নেই, কারণ তখন প্রাইভেট প্রপার্টির কোনও অস্তিত্বই ছিল না। আফ্রিকান, ভারতীয় কিংবা মিশরীয় সভ্যতার সংস্কৃতি তথা মাইথলজিতে সেই কারণে সমকামিতা বিরোধিতা সক্রিয় ভাবে লক্ষ্য করা যায়। সুইস্ রেড স্টার পত্রিকা অনুযায়ী, “In primitive society, there was a widespread system of third gender institutions. These were system of acceptance and respect for the people who today would be understood as queer: homosexual, bisexual, transgender people, also intersex people and non-binary people etc.”
কিন্তু সমকামী বা ট্রান্সজেন্ডার বা ইন্টারসেক্স মানুষেরা তাদের সম্পর্কের মাধ্যমে জৈবিকভাবে বংশবৃদ্ধি করতে পারেন না। তাই বংশগত ভাবে যখন প্রাইভেট প্রপার্টি ইনহেরিটেন্স এর মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সঞ্চিত হতে লাগল অর্থাৎ সভ্যতার উত্থান হল। যেদিন থেকে মাতৃতন্ত্রকে ভেঙে মানুষের লোভ জন্ম দিলো পিতৃতন্ত্রের, সেদিন থেকে সমকামীদের প্রতি সম্মান এবং প্রচলন উঠে গেল। বাইনারি মনোগ্যমাস সম্পর্কে মানুষকে বাধ্য করা হলো। ভালোবাসার স্বাধীনতার পরাজয় ঘটলো, জন্ম নিলো “Queer Antagonism!”
যদিও গ্রিক সভ্যতায় বহু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা গেছে। সমকামিতাকে এক্সেপ্ট করা হয়ে থাকত, যদি এই প্রাইভেট প্রপার্টির বংশ পরম্পরায় সঞ্চয়ন-এ সমকামী মানুষেরা সম্মতি জানাতেন। যেমন, গ্রিক হিরো আকিলিস! তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমকামী সম্পর্ককে সামন্ততন্ত্রের সময় থেকেই খুবই কঠোর ভাবে দমিয়ে দেওয়া হতো। খুবই কঠোর ভাবে সমকামী ও নারীদের স্বাধীনতা দমন করা হতো, এমনকি কমন সেঞ্চুরি পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। পিতৃতন্ত্রের সাথে সমকামী ও মহিলাদের স্থান বোঝা যায় এর থেকেই, যে ইউরোপিয়ো উইচ বার্নিং-এ জ্বালানি হিসেবে সমকামী মানুষ বিশেষত সমকামী পুরুষকে ব্যবহার করা হতো।
পুঁজিবাদী সমাজেও এই ভাবধারা লক্ষ্য করা যায়। আমেরিকার মতো দেশ যেখানে “প্রোডাক্ট ডিমান্ড” এর অধিকাংশটাই সমকামীদের থেকে আসে, সেখানেও queer antagonism বিদ্যমান। এক্ষেত্রে পুঁজিবাদী সমাজের ধারণা হলো নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি, যেখানে সম্পর্কের একজন শ্রম দেবে এবং প্রাইভেট প্রপার্টি বৃদ্ধির কাজ করবে এবং একজন সন্তানের লালন পালন করতে হবে। অর্থাৎ দত্তক বা অন্য কোনও উপায়ে সন্তান গ্রহণ না করলে, অর্থাৎ সম্পত্তি পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারের ব্যবস্থা না করলে queer antagonism অনুভব করতে হবে।
তবে আরেক দিক থেকেও সমকামিতার বিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়। স্বল্প হলেও কিছুক্ষেত্রে বামপন্থী আন্দোলনের মধ্যেও সমকামিতার বিরোধ বিদ্যমান। সুইস্ রেড স্টার পত্রিকা থেকে, “But there is another form of queer antagonistic ideology, which is present in the proleterian movement. Both in the labour movement and in the ICM. This is the problem of sexual metaphysics, or queer antagonistic revisionism.”
sex, sexuality and gender
সেক্স বা বায়োলজিক্যাল সেক্স এবং লিঙ্গ বা জেন্ডার, দুটি সম্পূর্ন ভিন্ন জিনিস। সেক্স হলো একটি বায়োলজিক্যাল construct এবং জেন্ডার হলো একটি সোশ্যাল construct অর্থাৎ সামাজিক ভাবনা। তাই সেক্স নির্ধারণ জন্মগত এবং লিঙ্গ নির্ধারণ পরিবর্তনশীল ভাবা হতো, তবে তা সঠিক নয়। সোশ্যাল construct হলো এমন একটি ধারণা যা শুধুমাত্র মানুষ ও তার পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে হওয়া ইন্টাররিলেশন এর মাধ্যমে সংগঠিত হয়। এই বিষয়গুলি অস্তিত্ব রাখে কারণ আমাদের প্রয়োজন হয় এবং আমরা মনে করি এগুলির অস্তিত্ব যাক গে, তাই এগুলি অস্তিত্ব রাখে। যেমন দেশ ও টাকার ধারণা। টাকা বা অর্থ বলতে কোনও বস্তু বা প্রোডাক্ট এর মূল্য বোঝানো হয়নি। কোনও বস্তুর মূল্য তার উৎপাদনে খরচ হওয়া শ্রমের উপর নির্ভরশীল। তাই লিঙ্গ যেহেতু একটি সোশ্যাল construct, তাই তা সর্বদাই নন বাইনারি। কারণ মানুষ কখনওই বাইনারি চিন্তাভাবনা বা অনুভূতি লাব করে না। মানব মস্তিস্ক জটিল। এবার আসি সেক্স এর ব্যাপারে। সেক্স একটি জৈবিক নির্ধারক বলে এর অস্তিত্ব আমাদের অনুভূতি বা প্রকৃতির সাথে আমাদের ইন্টাররিলেশন-এর সঙ্গে যুক্ত নয়। কিন্তু এটি অনেকগুলি দৈহিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে যুক্ত। যেমন শরীরে পুং এবং স্ত্রী হরমোনের অনুপাত, সেক্স হরমোনের উপস্থিতিতে দৈহিক পরিবর্তন, গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্য (যেমন - স্তন অথবা দাড়ি), মুখ্য যৌনঙ্গ (যেমন - শিশ্ন অথবা vagina) এবং সেক্স chromosome যথা X ও Y chromosome এর বিন্যাস (এটাও binary নয়। XX, XY, XXY, XYY, X ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের বৈশিষ্ট্য বিন্যাসে দেখা যায়। উপরোক্ত প্রায় সকল সেক্স নির্ধারকগুলি জন্মের পরবর্তীতে পরিবর্তন করা সম্ভব। কেবল chromosome বিন্যাস পরিবর্তন সম্ভব নয়। কিন্তু তা বায়োলজিক্যাল সেক্স-এর কুড়ি শতাংশও নির্ধারণ করে না। আবার সেই বিন্যাস ও বাইনারি নয়। কাজেই পুরুষ-স্ত্রী এই বাইনারি বাস্তবে অস্তিত্ব রাখে না। GENDER AND SEX, BOTH ARE NON BINARY!
এবার আসি যৌনতা বা sexuality র কথায়। sexuality বিভিন্ন রকমের হয় এবং এটি একটি স্পেকট্রাম। কারোর sexuality কোনও নির্দিষ্ট বিষয় নয়। মূলত একে চার ভাগে বিভক্ত করা যায় -
Heterosexuality: দুই বিপরীত লিঙ্গের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক।
Homosexuality: দুই সম লিঙ্গের প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের মধ্যে সম্পর্ক।
Bisexuality: যখন কোনও প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ সম এবং ভিন্ন উভয় প্রকারের লিঙ্গের প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের প্রতি আকর্ষিত হয়ে এবং সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে।
Asexuality: যখন কোনও প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ অপর কারোর প্রতিই যৌন আকর্ষণ অনুভব করে না। এটি অল্প থেকে একদম অনুপস্থিত ও হতে পারে। পরবর্তী সকল আলোচনায় সমকামী এবং ট্রান্সজেন্ডার মুক্তি আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই তিনটি বিষয় এবং এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পিতৃতান্ত্রিক দক্ষিনপন্থীরা বহু pseudo science এ বিশ্বাস করে, যা সমকামী ও ট্রান্স মানুষের ঐতিহাসিক oppression এর অন্যতম কারণ। তাই হিস্টোরিকাল মেটেরিয়ালিস্টিক আলোচনার সাথে বৈজ্ঞানিক আলোচনাও গুরুত্বপূর্ণ।
দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ ও সমকামী মুক্তি আন্দোলন
দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ অনুযায়ী ভাব ও বস্তু পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ ও ঐক্যে বর্তমান থাকে। ঠিক সেরকমই ট্রান্স মানুষদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের পরিচয় ও শারীরিক কাঠামো পরস্পরের সাথে দ্বন্দে ও ঐক্যে থাকে। এই দ্বন্দে সামাজিক পরিস্থিতির মাধ্যমে ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের মাধ্যমে শারীরিক পরিবর্তন ঘটে। ছোটো ছোটো পরিমানগত পরিবর্তন, গুণগত পরিবর্তনে পরিণত করে। মস্তিষ্কের শারীরিক পারিচয়ের অনুযায়ী শারীরিক কাঠামোর পরিবর্তন ঘটে। এবং পুরাতন লিঙ্গ পরিচয়ের নেগেশন অফ নেগেশন ঘটে। যান্ত্রিক বস্তুবাদী দিক দিয়েও দেখতে গেলে ইন্টারসেক্স লোকেদের উপস্থিতি লিঙ্গ পরিচয়ের জাড্যতা ধূলিসাৎ করে। তাই বামপন্থী তথা মার্ক্সবাদীদের সমকামী বিরোধিতার কোনও কারণ-ই থাকে না।
মার্ক্সবাদী হিসেবে কর্তব্য:
সমকামী মুক্তি ও ট্রান্স অধিকার আন্দোলন হলো ইনহেরিটেড উইল এর বিরুদ্ধে। তাই সমকামী মুক্তি আন্দোলন পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন। পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন হলো পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হলো moneyless, classless এবং stateless সমাজের উদ্দেশ্যে আন্দোলন। অর্থাৎ,
Fight for Communism!
source:
* “The origin of family, private property and the state” - Friedrich Engels
*Swiss “Red Star”